আমার শহর-সুজয় রায়

kol01 অতীতের ধূসর ইতিহাসে লুকিয়ে আছে অবশিষ্ট কিছু এই শহরের স্মৃতিসৌধ।সেদিকে তাকালে ও জানলে ভাবনা হয়, তাদের তুলনায় আমাদের বর্তমানকাল সত্যই রিক্ত।এককালে সরস্বতী নদী বহমান ছিল। সেই জলধারা অষ্টাদশ খ্রিস্টাব্দে পালিমাটিতে বুঁজে যায়। মধ্যযুগে এই নদীর তীরে সপ্তগ্রাম গঞ্জতে শ্রেষ্ঠীরা মুঘল সাম্রাজ্যের সঙ্গে ব্যাবসা-বাণিজ্য করত।পরবর্তী সময়ে তারা এসে হাওড়াতে ‘বিতর’-এ(আজকের ব্যাঁটরা)বাণিজ্যকেন্দ্র করে ব্যাবসা করতে লাগলেন পর্তুগিজদের সঙ্গে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬৯৮ সালে মাত্র ১৩০০ টাকা মূল্যে কলকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুর গ্রাম কিনেছিল বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের কাছ থেকে। সেই থেকে আজকের শহরের সূত্রপাত। এই ঘটনার পরিণাম কিপলিং লিখেছেন,“chance directed,chance erected” কলকাতা নগরী।

ক্রমে সেই সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি সিকদারদের মধ্যে ভাগ হতে হতে প্রায় নিশ্চিহ্ন হল।অবশিষ্ট আছে ৩৭৫ বছর পুরাতন দুর্গাপূজা,ঠাকুরদালান। আর আছে আটচালার কয়েকটা থাম ও কুলদেবতা রাধাকান্ত জিউ-এর বিগ্রহ।

kol02কলকাতার লালদিঘির আশপাশে ছিল এই বংশের লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরীর কাছারিবাড়ি। আর ছিল শ্যামরায়ের মন্দির। সেখানে ধুমধাম করে দোল উৎসব হত,আবিরের রঙ লেগে দিঘির জল হয়েছিল রঙিন।তাই দিঘির নাম লালদিঘি।

চোরবাগানের মিত্রবাড়ির কথা বলা যেতে পারে।আজ যেটা মুক্তারামবাবু স্ট্রিট সেখানে অবস্থিত এ বাড়ি। সেইকালে বনবাদাড় অতিক্রম করে গঙ্গা স্নানার্থীরা এই পথ ধরে যেত। প্রায়শই তাদের সর্বস্ব লুট হয়ে যেত ডাকাতদলের হাতে। তাই চোরবাগান কুখ্যাতি।

মিত্রবাড়ি ৩৫০ বছরের বেশি পুরোনো।এটি তৈরি করেছিলেন রামসুন্দর মিত্র, তাঁকে  ডাকতো খ্যাঁদারাম মিত্র নামে। মিত্র পরিবারের আদি বাড়ি কোন্নগর। মুর্শিদাবাদের নবাবের কাছে দেওয়ানি পেয়েছিলেন পূর্বপুরুষ রামরাম মিত্র। ভূমিকম্পে এই বাড়ির ক্ষতি হয়। প্রায় পাঁচ বিঘা জমির উপর বাড়ি ম্যাকিনটশ বার্নের সাহায্যে অনেক পরিবর্তন করা হয়। গ্রিক স্থাপত্যে নির্মিত তিনতলা এই বাড়ি। দেশবিদেশ থেকে আনা বিচিত্র নান্দনিক জিনিস এখানে আছে।দুর্মূল্য শিল্পসামগ্রী এখানে ছড়ানো আছে।

রাজা বিজয়কৃষ্ণদেবের মৃত্যুর পর তাঁর সংগ্রহ করা জিনিস মিত্রবংশ কিনেছিল নিলাম থেকে। আরও অনেককিছু কেনা হয়েছিল দালালদের হাত ঘুরিয়ে ও সাহেবদের সংগ্রহ থেকে। এত জিনিস ছিল,কিন্তু কোনো লাইব্রেরি অথবা পুঁথি এঁদের সংগ্রহে ছিল না। এঁরা লবণের ব্যাবসা করতেন। রামসুন্দর মিত্রের ছিল মহাজনি কারবার। ওয়ারেন হেস্টিংস এঁদের কাছ থেকে দৈনিক সুদে টাকা ধার নিতেন। অন্যান্য সাহেব ও তৎকালীন বিখ্যাত পরিবারগুলো মিত্রবংশের পরবর্তী প্রজন্মদের কাছ থেকে ধার করতেন। সে যুগে মিত্রবংশ ছিলেন যেন প্রায় আজকের দিনের ব্যাঙ্কার। এই পরিবারের অমৃতনাথ রায় বাহাদুরও ইন্ডিয়ান মুসলিমের ট্রাস্টি হয়েছিলেন।দুর্ভিক্ষত্রাণ ও ভিক্টোরিয়া ফান্ড-এ অর্থদান করেছিলেন এই পরিবার।

kol03নরেন্দ্রনাথ মিত্রের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে প্রায় দেড়শত পন্ডিত এসেছিলেন। উৎসব উপলক্ষে এখানে খাওয়ার তালিকা শেষ করা যায় না লিখে। তালিকার মধ্যে ছিল ১১৭টি নিরামিষ খাদ্যের পদ। বনেদি বাড়ির ভোজনের বিবরণ শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে।এঁদের কালীপুজো ৩৩০ বছরের পুরোনো। চোরবাগানের মিত্রবাড়ির কালী ভয়ংকারী নন,বিহারিণী।

মহাজনি কারবার ব্যতীত এই পরিবারের জমিদারী ছিল প্রচুর লাভজনক। গোবড়ডাঙার নিকট হরদতপুরে জমিদারী ছিল। ডালহৌসি স্কোয়ার, ইন্ডিয়া এক্সচেঞ্জ প্লেস, ক্যানিং স্ট্রিট,বউবাজার,লাউডন স্ট্রিট,পার্ক স্ট্রিট,কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট, কুমারটুলি ইত্যাদি এলাকাতে ক্রমে বিষয়সম্পত্তি বেড়ে উঠেছিল।এইসব এলাকাতে এই পরিবারের ভাড়াবাড়ির সংখ্যা অনেক, নিজেদের বসত-বাড়ির অংশবিশেষ ভাড়া দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি।পূর্বাঞ্চলীয় রঞ্জি ট্রফি বিজয়ী রাজ্যকে যে মনা মিত্র চ্যালেঞ্জ কাপ দেওয়া হয়,সেই মনা মিত্র এই বাড়ির সন্তান।

৭৮ নিমতলা ঘাট স্ট্রিটে হাটখোলার দত্তবাড়ি কলকাতার আরেক অন্যতম পুরোনো বাড়ি।এই বাড়ি অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে তৈরি করেন জগতরাম দত্ত।তিনি ছিলেন পাটনাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমদানি রপ্তানি বিভাগের দেওয়ান।এঁর দুই পুরুষ আগে রামচন্দ্র দত্ত-ও ছিলেন দেওয়ান ও জমিদার।

জগতরামের ঠাকুরদালানে দুর্গা ও কালীপূজা হয়।২০০ বছরের বেশি পুরাতন দুর্গাপূজা। এখন পর্যন্ত প্রতিমা ভাসানের সময় নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানো হয়।দেবী দুর্গা যে ফিরে যাচ্ছেন এই পাখি সেই খবর আগাম দিতে যায় শিবকে। এই পরিবারের নানা শাখাপ্রশাখা বিস্তার হয়েছে। তিনটি বাড়িতে সাবেককালের রীতি মান্য করে দুর্গাপূজা হয় এবং প্রতিমা হয় একইরকম দেখতে।

kol04আগে এই বাড়ি লোকমুখে ‘পাখিওলা বাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। রামনাথ দত্ত ছিলেন পাখিবিশারদ ও পাখিচিকিৎসক। ছিলেন বিখ্যাত পাখোয়াজবাদক। তাঁর প্রকান্ড পাখোয়াজের জুড়ি প্রবীণরাও দেখেননি।শোভাবাজারের রাজবাড়ির মত ইংরেজতোষণ এঁরা করেননি। শোভাবাজার রাজবাড়িতে একটা সিঁড়ি আছে। স্থানীয় লোকেরা তাকে বলে, “ঘোড়াতোলা সিঁড়ি”। সিঁড়ি ভেঙে দুইতলা উঠতে সাহেবদের পরিশ্রম হবে, তাই রাজা ঘোড়ার দোতলায় যাতায়াত করবার জন্য সিঁড়ি বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন।দত্তরা সেই উদাহরণ অনুসরণ করেন নি।

দত্ত পরিবারের শাখা প্রশাখা ব্যাপক ছড়িয়ে গেছে। আছেন বহু কৃতি পুরুষ। ভক্তবিনোদ কেদারনাথ দত্ত এই পরিবারের “দত্ত বংশমালা” নামে লিখেছেন পারিবারিক ইতিহাস। সেটা লেখা হয় ১৮৭৬ সালে। বর্তমানে এঁদের ২৯তম প্রজন্ম চলছে। প্রাণকৃষ্ণ দত্ত, তিনিও বংশের ইতিহাস লিখেছেন। পটলডাঙার বসুমল্লিক পরিবার বিবাহসূত্রে এঁদের আত্মীয়। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু দত্তবাড়ির নাতি। রাজনারায়ণ বসুর স্ত্রী নিস্তারিণী হাটখোলার দত্তবাড়ির মেয়ে। তাঁর বড়োমেয়ে স্বর্ণলতার চার ছেলে।তার মধ্যে একজন ঋষি অরবিন্দ,আর এক ছেলে বারীন্দ্র ঘোষ।

দত্তবাড়ির প্রবেশপথে আছে ঢেঁকি। তিথি-নক্ষত্র মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ঢেঁকি পূজা করা হয়।পুরাতন প্রথা আজও ধরে রাখা হয়েছে।

দত্তবাড়ির লোকদের নামে কলকাতায় মদনমোহন দত্ত লেন, কাশীনাথ দত্ত রোড, নিমতলার ঘাট।তনুবাবুর ঘাট রামতনু দত্তর স্মরণে আছে।তনুবাবু সকাল-সন্ধ্যা বাড়ি গোলাপজলে ধোয়া মোছা করতেন। বসরাই গোলাপের নির্যাস আসত মির্জাপুর থেকে।

বিখ্যাত কাশিমবাজার রাজবাড়ির সমৃদ্ধি হয় রেশম,পান-সুপারি,ঘুড়ি,তাঁত বুনে কাপড়ের ব্যাবসা থেকে। ব্যাবসা শুরু করেন রাধাকৃষ্ণ নন্দী। ভালো ঘুড়ি ওড়াতেন তিনি। তাঁর প্রথম ছেলে কৃষ্ণকান্ত কাশিমবাজার রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতায় এঁদের পুরাতন বাড়ি ২৬৩ চিৎপুর রোডে। সেটা ভাড়া দেওয়া হয়েছে। নন্দীরা এখন থাকেন ৩০২ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে। এটাই এখন কাশিমবাজার রাজবাড়ি নামে পরিচিত। কলকাতা টাঁকশালের অধীক্ষক জেমস ফরবেস ১৮০০ সালে এই বাড়ি তৈরি করেন। ফরবেসের কাছ থেকে ১৮২৪ সালে সেই বাড়ি কিনে নেন কাশিমবাজারের রাজা হরিনাথ। রানি স্বর্ণময়ীর সময় এই বাড়ির নাম হয় রানিকুঠী। এখানে দুটি পুকুর ও ২০ বিঘে জমির ওপর এই বাড়ি, পূর্বে সেটা ছিল বাগানবাড়ি। 

১৭৫৪ সালে হেস্টিংসের বেনিয়ান হয়েছিলেন কৃষ্ণকান্ত নন্দী। তিনি নাকি হেস্টিংসকে লুকিয়ে রেখে নবাবের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়েছিলেন। কৃষ্ণকান্ত প্রচুর জমি কিনে সম্পত্তি বাড়িয়েছিলেন। তিনি মুর্শিদাবাদ, মালদা, রংপুর ও মেদিনীপুরের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে। যাঁরা এক একটি পরগনার রাজস্ব বেশি আদায় করতে পারতেন তাঁরাই এই অধিকার পেতেন কোম্পানির কাছ থেকে। এই নিয়মের নাম ছিল “রেভেনিউ ফার্মিং” অর্থাৎ “রাজস্ব কর্ষণ”। বহু সাধারণ গ্রামবাসীর চোখের জল মিশে গিয়েছিল এই প্রথার সঙ্গে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হলে এঁরা জমিদার হয়ে উঠেছিলেন। কৃষ্ণকান্ত পেয়েছিলেন ১৩টি পরগনায় রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব।

kol05কৃষ্ণকান্ত হিজলী, তমলুক,মহিষাদল ইত্যাদি অঞ্চলে লবণ উৎপাদন করিয়ে প্রচুর আয় করেছিলেন। মেদিনীপুরে ত্রিশ শতাংশ এলাকায় লবণ উৎপাদন করতেন। এই অত্যন্ত লাভজনক ব্যাবসা কলকাতার অনেক বনেদি পরিবার করত অষ্টাদশ শতাব্দি জুড়ে। রাজা শ্রীশচন্দ্র নন্দীর ছেলে সমেন্দ্রচন্দ্র এই শহরের পুরাতন থামওয়ালা বাড়ি দেখলে তাদের পূর্ব মালিকদের নাম লবণ ব্যাপারীদের তালিকা থেকে বলে দিতে পারেন বলে দাবি করেন। লবণ উৎপাদকদের, মালুঙ্গি ও নীলচাষীদের ওপর অকথ্য অত্যাচারের ইতিহাস এক বিষাদময় অধ্যায়। এই বংশের হরিনাথ নন্দী দানধ্যান করে নাম করেছিলেন। হরিনাথ হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করবার জন্য ২০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন।কবিয়ালদের ও ধুলিদারদের এক রাত্রির আসরে মোটা টাকা দিতেন। হরিনাথের পুত্র কৃষ্ণনাথের স্ত্রী স্বর্ণময়ী ৭০ লক্ষ টাকা দান করেছিলেন বিভিন্ন সৎকার্যে, যেমন স্ত্রীশিক্ষা, নিখরচায় ধাত্রীবিদ্যা শিক্ষা। স্বর্ণময়ীর ছেলে মণীন্দ্রচন্দ্র প্রায় তিন কোটি টাকা দান করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়,বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ,ল’কলেজ,কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ,কারমাইকেল হাসপাতাল(এখনকার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল),আর.জি.কর মেডিক্যাল কলেজ, বেঙ্গল কেমিক্যাল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে।

এই বংশের সোমেন্দ্রচন্দ্র ঐতিহাসিক ও নাট্যকার। তাঁর লেখা “লাইফ এন্ড টাইমস অফ কান্তবাবু” দেশে ও বিদেশে সমাদৃত। অষ্টাদশ শতকের ভূমিব্যবস্থা, জমিদারী ও সমাজব্যবস্থা নিয়ে গবেষণামূলক এই লেখা।

ক্রমশ

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান